মানি লন্ডারিং (Money Laundering)

537
article image

সাল ২০১৬, পানামা পেপারস নামে হঠাৎ করেই ফাঁস হয় ১ কোটি ১৫ লক্ষ গোপন নথি। কি ছিল এসব নথিতে? এখানে ছিল সভ্যতার মুখোস পড়া অসংখ্য অবৈধ ব্যবসায়ী, সেলিব্রিটি, স্মাগলার দের কালো টাকার কাগজ পত্র। এই সব কালো আর অঘোষিত টাকাকে বিভিন্ন জটিল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছিল বৈধতা। প্রায় ১১৪০ কোটি টাকাকে বৈধতা দেয়ার রেকর্ড পাওয়া যায় এই ঘটনায়।

Key Points

  • মানি লন্ডারিং বা অর্থ শোধন হল, একটি অবৈধ প্রক্রিয়া যা অবৈধভাবে অর্জিত অর্থের উৎস লুকানোর জন্য ব্যবহার করা হয়।
  • একে সাধারণত অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ কে বৈধতা দেয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়।
  • মানি লন্ডারিং তিনটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়: প্রবেশন (Placement), স্তরণ (Layering) এবং একীভূত করা (Integration).
  • মানি লন্ডারিং একটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিচারিত হয় এবং এটি বিশ্বব্যাপী অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পরিশোধনের একটি প্রধান উপায়।
  • বিভিন্ন দেশে মানি লন্ডারিং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যেমন, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স।

মানি লন্ডারিং কি?

শুধু পানাম পেপার্সই নয়, বিশ্বব্যপী মানি লন্ডারিং অর্থাৎ অবৈধ অর্থকে বৈধতা দেয়ার এই প্রক্রিয়া ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলছে। জাতিসংঘের তথ্য মতে, এরর কারণে আনুমানিক ৪-৫% বৈশ্বিক জিডিপি, বা ট্রিলিয়ন ডলারের লস হচ্ছে প্রতি বছর। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার ও আন্তর্জাতিক ফাইনান্সিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে। মানি লন্ডারিং নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে।

মানি লন্ডারিং বলতে, অবৈধভাবে অর্জিত অর্থের উৎস কে লুকানোকে বুঝায়। এখানে সাধারণত অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ (যেমন মাদক ব্যবসা, জালিয়াতি, চোরাই মালের বিক্রি, ঘুষ ইত্যাদি) বৈধ অর্থে পরিণত করা করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত, অবৈধভাবে অর্থের উৎস লুকানোর জন্য এবং সরকারের নজর থেকে বাঁচার জন্য ব্যবহার করা হয়।

এটি মূলত তিন ধাপে সম্পন্ন হয়: প্রথমত, "প্লেসমেন্ট" যেখানে অবৈধ অর্থ বৈধ অর্থ প্রণালীতে প্রবেশ করে, অর্থাৎ ব্যংক কিংবা দেশের ফাইনান্সিয়াল ফ্লো তে চলে আসে। দ্বিতীয়ত, "লেয়ারিং" যেখানে অর্থের উৎস লুকানো হয়, অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের ভুয়া তথ্যের মাধ্যমে অবৈধ অর্থের আসল উৎসকে ধামাচাপা দেয়া হয়। এবং তৃতীয়ত, "ইন্টিগ্রেশন" যেখানে অর্থ পুনরায় বৈধ ফাইনান্সিয়াল সিস্টেম এ ফিরে আসে। অর্থাৎ বিভিন্ন ভাবে অর্থকে পরিশোধিত করার পর, এগুলেকে একত্রিত করা হয়।

উদাহরণস্বরূপ, ধরুন আপনার কাছে অবৈধ ভাবে উপার্জন করা কিছু অর্থ আছে। এগুলো ব্যংকে রাখলে আপনি দ্রুত ব্যংক কর্মকর্তা, সরকার কিংবা আইনের চোখে সন্দেহের দৃষ্টিতে পড়বেন। এখন আপনি এই অর্থ গুলো ব্যংকে জমা করার জন্য ভূয়া কাগজপত্র ব্যবহার করলেন। যেমন ১০ লক্ষ মূল্যের জমিকে ৩০ লক্ষে বিক্রি দেখিয়ে, ব্যংকে জমা করলেন। এটা ছিল প্রথম ধাপ, অর্থাৎ অবৈধ টাকাকে ফাইনান্সিয়াল সিস্টেম এ প্রবেশ করানো।

এরপর আপনি টাকা গুলো আবারো উঠিয়ে ফেললেন, কোনো বিজনেস এ ইনভেস্ট করলেন, কিংবা গাড়ি, বাড়ি নতুন জমি কিনলেন। এভাবে টাকা গুলো অনেক গুলে ভাগ হলে গেল। আর আসল উৎসই অনেক কিছুর আড়ালে হারিয়ে গেলো। এটা ছিল লেয়ারিং স্টেজ। এবং সর্বশেষ, আপনি আপনার প্রয়োজনমত জমি, বিজনেস ও অন্য উৎস থেকে টাকা গুলে একীভূত করলেন। কিন্তু এখন আপনার কাছে সব টাকার বৈধ ডকুমেন্টস আছে। এটাই ছিল মানি লন্ডারিংয়ের ফাইনাল স্টেজ, ইন্টিগ্রেশন।

বাংলা ট্রিবিউন, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বরাত দিয়ে জানায়, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে মোট কালো টাকার পরিমাণ ১ কোটি ৩২ লাখ কোটি টাকা। আর পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ১১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা।

মানি লন্ডারিং এর ধরন

টাকার উৎস, গোপন করার ধরন, ক্যাশ কিংবা ব্যংক ট্রান্সফার কিংবা বিনিয়োগের ওপর ভিত্তি করে মানি লন্ডারিং অনক ধরনের হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী রেকর্ড হওয়া সবচেয়ে কমন মানি লন্ডারিং গুলো হল-

১. স্ট্রাকচারিং (স্মারফিং):

এই পদ্ধতিতে, বিপুল পরিমাণ অবৈধ ফান্ডকে ছোট ছোট, এবং কম সন্দেহজনক লেনদেনে বিভক্ত করা হয়। আর সনাক্তকরণ এড়ানোর জন্য এই ছোট লেনদেনগুলি সাধারণত রিপোর্টিং থ্রেশহোল্ডের অধীনে থাকে।

২. ক্যাশ ইন্টেনসিভ বিজনেস:

এই ক্ষেত্রে অপরাধীরা এমন ব্যবসা ক্রিয়েট করে যেখানে প্রাথমিকভাবে নগদে লেনদেন করতে হয়, যেমন রেস্তোরাঁ বা ক্যাসিনো। এটা মূলত বৈধ উপার্জনের সাথে অবৈধ ফান্ড মিশ্রিত করার জন্য করা হয়। এতে করে অর্থের উৎস খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে।

৩. শেল কোম্পানি:

অপরাধীরা তাদের অর্থ স্থানান্তরের জন্য প্রায়ই অফশোর থেকে জাল কোম্পানি তৈরি করে। এগুলোকেই শেল কোম্পানি, আড়ালে থাকা কোম্পানি বলা চলে। এই শেল সংস্থাগুলি আসলে অবৈধ ফান্ড গুলোকে লিগ্যাল বলে মনে করার জন্য কাল্পনিক লেনদেন করে থাকে। যেমন, ৪০ লক্ষ টাকাকে লন্ডারিং করার জন্য একটি ফেইক কম্পানি খোলা হয়। এবং নিজেরাই লেনদেন করে লাভ ৪০ লাখ দেখানো হলো। পুরোটাই বায়োনাট হলেও, টাকা গুলো বৈধতা পেয়ে গেল।

৪. ট্রেড বেইসড মানি লন্ডারিং:

বানিজ্য ভিত্তিক লন্ডারিংয় বা ট্রেড বেইসড মানি লন্ডারিংয়ের বর্তমানে সবচেয়ে বেশি প্র্যাকটিডস লন্ডারিং। এক্ষেত্রে, অপরাধীরা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পণ্যের মূল্য নির্ধারণে এবং চালানে হেরফের করে যাতে অবৈধ অর্থকে হাইড করে করে সীমানা অতিক্রম করতে পারে এবং অর্থ স্থানান্তর করতে পারে।

যেমন, আমদানি করার ক্ষেত্রে প্রোডাক্টের দাম অনেক বেশি দেখিয়ে ওই টাকা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দেখা যায় দেশের বাইরে ট্রান্সফার হওয়া অর্থ তার পরিচিত কারো কাছেই রয়েছে। কিন্তু কাগজপত্রে বৈধতা দেখিয়ে দেশের বাইরে টাকা পাঁচার হয়ে গেছে। এই ধরনের ট্রেড বেইসড মানি লন্ডারিংয় কে বলা হয়, ওভার ইনভয়েসিং। আর রপ্তানির আড়ালে অর্থ আত্মসাৎ করাটাকে আন্ডার ইনভয়েসিং বলা হয়

৫. রিয়েল এস্টেট লেনদেন:

এই ধরনের লন্ডারিং এ অর্থ রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করা হয়। এগুলো দিয়ে অপরাধীরা সম্পত্তি ক্রয় করে তাদের অবৈধ টাকাকে বৈধ করে নেয়। আবার বৈধভাবে অর্থ পুনরুদ্ধার করার জন্য সম্পত্তিগুলি পরে বিক্রি করে দেয়।

৬. অনলাইন এবং ডিজিটাল পদ্ধতি:

বর্তমানে, অনেক অপরাধীরা অর্থ পাচারের জন্য ক্রিপ্টোকারেন্সি বা অনলাইন লেনদেন ব্যবহার করে। এগুলো টাকার উৎস এবং গন্তব্য সনাক্ত করা কঠিন করে তোলে।

৭. হাওয়ালা সিস্টেম:

কিছু ট্রেডিশনাল, ফরমাল মানি লন্ডারিং স্ট্র্যাটেজি আছে যেগুলো সীমান্ত এলাকায় বেশি দেখা যায়। এখানে, ফরমাল কাগজপত্রে টাকা কোনো কারনবশত দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে দেখানো হয়। কিন্তু কাগজে দেখানো হলেও কৌশলে সেই টাকা আবার দেশে নিয়ে আসা হয়।

৮. অফশোর অ্যাকাউন্ট:

অনেক সময়ে অবৈধ টাকা গুলো অফশোর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, ট্যাক্স হেভেন ইত্যাদি তে ট্রান্সফার করা হয়। আর তাদের কঠোর ব্যাঙ্ক সিকিউরিটি আইনের কারণে কর্তৃপক্ষের পক্ষে অর্থের সন্ধান করা কঠিন হয়ে যায়।

৯. জুয়া এবং বাজি:

অপরাধীরা অবৈধ অর্থকে জয় বা ক্ষতিতে রূপান্তর করতে ক্যাসিনো, বাজি বা অনলাইন জুয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে পারে যা তারপরে লিগ্যাল মানি হিসাবে ক্যাশ আউট করে ফেলে। যেসব দেশে ক্যাসিনো জুয়া অবৈধ নয় সেখানে এসব প্র্যাকটিস হয়ে থাকে।

১০. শিল্প এবং বিলাসবহুল সম্পদ:

এক্ষেত্রে, অর্থ শিল্প, গয়না বা বিলাস দ্রব্যের মতো মূল্যবান সম্পদ কেনার জন্য অবৈধ টাকা ব্যবহৃত হয়। পরে এই টাকাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য পরে পুনরায় বিক্রি করে দেয়া হয়।

১১. নগদ চোরাচালান:

অবৈধ টাকা যাচাই-বাছাই এড়াতে ঘোষণা ছাড়াই সীমানা অতিক্রম করে শারীরিকভাবে পরিবহন করা হয়। অর্থাৎ, নিজের অবৈধ টাকাকে একজন অপরাধী ভারত নিয়ে যেতে চাচ্ছে। সে সিমানা অতিক্রমের সময়ে টাকাকে রুপিতে ট্রান্সফার করে নিয়ে দেশের বাইরে চলে যেতে পারবে। এখানে কেউ তাকে টাকার উৎস জানতে চাইবে না।

১২. দাতব্য সংস্থা এবং নন প্রোফিট:

অপরাধীরা মিথ্যা চ্যারিটি স্থাপন করে বা বৈধ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে অর্থ ফানেল করতে পারে। এগুলো টাকার প্রকৃত উৎস সনাক্ত করা কঠিন করে তোলে।

বণিক বার্তার তথ্যমতে বিগত সরকারের ১৫ বছরের শাসন আমলে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা

মানি লন্ডারিংয়ের বাস্তব উদাহরণ

সারাবিশ্বে প্রতিবছর ২ ট্রিলিয়ন মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা ঘটে। ইতিহাসে সারাজাগানো এমন কিছু কুখ্যাত মানি লন্ডারিংয়ের ঘটন হল-

১. ব্যাংক অফ ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল (BCCI) এর মামলা

১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দশকে, ব্যাংক অফ ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল (BCCI) নামে একটি ব্যাংক ছিল। এটি দেখতে একটি রেগুলার ব্যাংকের মতো হলেও, এটি গোপনে অপরাধী এবং দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের তাদের অর্জিত অর্থ লুকিয়ে রাখতে সহায়তা করত।

ব্যাঙ্কটি মাদক পাচারকারী, অস্ত্র ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য অপরাধীদের কাছ থেকে অর্থ নিতো এবং এটি বৈধ ব্যবসা থেকে এসেছে বলে কাগজপত্র রেডি করে দিত। এজন্য জাল রেকর্ড, শেল কোম্পানি এবং প্রচুর গোপনীয়তা ব্যবহার করেছিল। ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা আগা হাসান আবেদী এবং এর কর্মচারীরা এই অবৈধ প্রকল্পে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল।

কর্তৃপক্ষের কাছে এদের ধরার জন্য কিছু সময় লেগেছিল, কিন্তু ১৯৯১ সালে, ব্যাংকটি তার অর্থ পাচার কার্যক্রমের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। এটি ছিল ইতিহাসে অর্থ পাচারের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে কুখ্যাত ঘটনাগুলির মধ্যে একটি।

২.পাবলো এসকোবার কানেকশন:

১৯৮০ এর দশকে, কুখ্যাত কলম্বিয়ান ড্রাগ লর্ড পাবলো এসকোবার তার ড্রাগ সাম্রাজ্য থেকে অভাবনীয় মুনাফা করছিলেন। এই নোংরা অর্থকে বৈধতা দেওয়ার জন্য, তিনি রিয়েল এস্টেট, ব্যবসা এবং এমনকি একটি পেশাদার ফুটবল দলেও বিনিয়োগ করেছিলেন। এগুলো করে, তিনি আপাতদৃষ্টিতে আইনি উদ্যোগের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ ডলার পাচার করেছেন।

পাবলো এর সংস্থা টি এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের লন্ডারিং স্ট্র্যাটেজি বাদ রাখে নি। পর্যন্ত প্রমান না থাকায় ও অবৈধ টাকারও বৈধ নথিপত্র থাকায়, পাবলোর অসংখ্য অপরাধ ওপেন সিক্রেট হিসেবে রয়ে গেছে।

৩. সিমেন্স ঘুষ কেলেঙ্কারি:

২০০০ এর দশকের মাঝামাঝি, জার্মান বহুজাতিক কোম্পানি সিমেন্স একটি বিরাট ঘুষ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পরে। তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে নকল চুক্তি দেওয়া ও কোটি কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ছিল। এই অবৈধ অর্থপ্রদান লুকানোর জন্য, সিমেন্স শেল কোম্পানি এবং অফশোর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট গুলোর জটিল ওয়েব ব্যবহার করতো। এই মামলাটি মাধ্যমে বোঝা যায়, কিভাবে বড় কর্পোরেশনগুলি ব্যবসায়িক লেনদেন সুরক্ষিত করতে অর্থ পাচারের সাথে জড়িয়ে পরে।

৪. পানামা পেপারস লিক:

২০১৬ সালে, পানামা পেপারস ফাঁস ঘটনায়, অফশোর কোম্পানিগুলির একটি বিশাল নেটওয়ার্ক এবং সারা বিশ্বের রাজনীতিবিদ, সেলিব্রিটি এবং ব্যবসায়ীদের ব্যবহৃত গোপন অ্যাকাউন্ট ও ১ কোটি ১৫ লক্ষ নথি বিশ্বের সামনে উন্মোচিত হয়েছিল৷ এইসব ব্যক্তিরা ট্যাক্স পরিশোধ এড়াতে এবং কিছু ক্ষেত্রে তাদের সম্পদের উৎস লুকানোর জন্য পানামার মতো ট্যাক্স হেভেনগুলোতে তাদের অর্থ জমা করছিলেন। ওই বছর প্রায় ১১৪০ কোটি অবৈধ অর্থের খোঁজ পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের অর্থ পাচার

অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ কখনই তাঁর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। বার বার আঘাত এসেছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সহ নানা দিক থেকে। তার মধ্যে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে এই অর্থ পাচার। বাংলা ট্রিবিউন, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বরাত দিয়ে জানায়, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে মোট কালো টাকার পরিমাণ ১ কোটি ৩২ লাখ কোটি টাকা। আর পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ১১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা (০৩ জুন ২০২৪) [১]। আর বণিক বার্তার তথ্যমতে বিগত সরকারের ১৫ বছরের শাসন আমলে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা (আগস্ট ০৭, ২০২৪) [২]। আর বাংলাদেশের বর্তমানের ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ যে ঋণ নিয়ে সবার ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে তা শুধু পাচার হওয়া অর্থ দিয়েই পূরণ করা সম্ভব।

বাংলাদেশে অর্থ পাচারের অন্যতম একটি বড় মাধ্যম হলও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। বিবিসি বাংলা তার একটি প্রতিবেদনে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) এর বরাত দিয়ে জানায়, "২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়, টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা।" (৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩) [৩]

একটা সময় বাংলাদেশের অর্থ পাচার হতো ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে। এখন সেই স্থান দখল করে নিয়েছে দুবাই সহ মধ্য প্রাচ্যের দেশ গুলো। ইউরোপ-আমেরিকার মতো বেগমপাড়াও গড়ে উঠছে সেইসব দেশে। আগে অর্থ পাচারের অভিযোগ সবচেয়ে বেশী উঠতো রাজনীতিবিদ আর ব্যবসায়ীদের দিকে আর এখন পুলিশ থেকে শুরু করে আমলা সরকারি কর্মকর্তা এমনকি পিওনও এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। যে যেভাবে পারছে দেশের সম্পদ লুটছে।

ব্যাংকগুলো সব অন্তঃসারশূন্য হয়ে পরেছে। ব্যাংক থেকে নেওয়া কিন্তু আদায় হবেনা এমন ঋণের পরিমাণ অন্তত ৭ লাখ কোটি টাকা। এই ঋণের বড় অংশই দেশ থেকে পাচার হয়ে গিয়েছে। যার চড়া মূল্য দিতে হবে এই দেশের সাধারণ মানুষকেই।

এই পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে প্রতি বছরই দৌড় ঝাঁপ চলে। কিন্তু লাভের লাভ হয়না কিছুই। হবে কিভাবে সবার এত স্বার্থ যে জড়িত থাকে!



উপসংহার

ভাবতে অবাক লাগলেও বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর, ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এর লন্ডারিং হচ্ছে। শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই এর পরিমান ২৪ বিলিয়ন। অনেক দেশেই অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং (AML) আইন প্রয়োগ করেছে। এবং এই সমস্যাটি মোকাবেলা করার জন্য ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) নামের একটি মূল আন্তর্জাতিক সংস্থা AML নীতিতে কাজ করা শুরু করেছে এবং এখানে প্রায় ২০০ সদস্যের টিম রয়েছে।

বাংলাদেশেও মানি লন্ডারিং একটি বৃহৎ সমস্যা। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এই সমস্যার সমাধানে কাজ করে যাচ্ছে। তবে, এটি এখনও একটি বৃহৎ চ্যালেঞ্জ হিসেবেই রয়ে গেছে।

  • https://bangla.latestly.com/entertainment/bollywood/what-is-panama-paper-case-take-a-look-102751.html
  • https://assets.publishing.service.gov.uk/media/5a816bd1e5274a2e87dbd891/CF_Bill_-_Factsheet_1_-_The_Bill.pdf
  • https://economictimes.indiatimes.com/definition/money-laundering
  • https://www.banglatribune.com/business/849706/%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6-%E0%A6%A5%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B9%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A7%A7%E0%A7%A7-%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%96-%E0%A7%AF%E0%A7%A8-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BE [১]
  • https://bonikbarta.net/home/news_description/394108/%E0%A7%A7%E0%A7%AB-%E0%A6%AC%E0%A6%9B%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%93%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%80-%E0%A6%B8%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%8B%E0%A6%A3-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A7%87-%E0%A7%A7%E0%A7%AB-%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%96-%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%BF [২]
  • https://www.bbc.com/bengali/articles/cv25v04wwl6o [৩]
  • 
Next to read
Marketing
সারোগেট মার্কেটিং (SURROGATE MARKETING)
সারোগেট মার্কেটিং (SURROGATE MARKETING)

একটি কোম্পানি যখন তার একটি (প্রচলিত আইনে বিজ্ঞাপনের জন্য বৈধ নয় এমন) পণ্যকে বিজ্ঞাপন করার জন্য অন্য একটি (বৈধ) পণ্যকে ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন করে থাকে তাই সারোগেট মার্কেটিং। যেমন: বিয়ার বিজ্ঞাপনের জন্য বৈধ নয় কিন্তু "Kingfisher" এয়ারলাইন্স এর বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে "Kingfisher" এর বিজ্ঞাপন করে যাচ্ছে। এতে করে আইনও যেমন ভাঙ্গা হলো না তেমনি আবার মানুষের মাঝে নিজ প্রতিষ্টানকে পরিচয় করিয়েও দেওয়া গেলো।

লোগোর প্রকারভেদ (Types of Logos)
Logo
লোগোর প্রকারভেদ (Types of Logos)
লোগো ব্যবহারের সুবিধা অসুবিধা (Pros and Cons of Logo Usage)
Logo
লোগো ব্যবহারের সুবিধা অসুবিধা (Pros and Cons of Logo Usage)
নিট মুনাফা (net profit) সংজ্ঞা, সূত্র এবং কিভাবে হিসাব করবেন
Business
নিট মুনাফা (net profit) সংজ্ঞা, সূত্র এবং কিভাবে হিসাব করবেন
হোরেকা (HORECA)
Business
হোরেকা (HORECA)
বিক্রয় বৃদ্ধি করার ৬টি নীতি
Sales
বিক্রয় বৃদ্ধি করার ৬টি নীতি
সেলস টার্গেট অর্জনের জন্য ১০টি বডি ল্যাঙ্গুয়েজ টিপস
Sales
সেলস টার্গেট অর্জনের জন্য ১০টি বডি ল্যাঙ্গুয়েজ টিপস
ব্র্যান্ড আর্কিটেকচার কী? সংজ্ঞা, মডেল এবং উদাহরণ
Branding
ব্র্যান্ড আর্কিটেকচার কী? সংজ্ঞা, মডেল এবং উদাহরণ
Startup funding Pre-seed to series A, B, C brief discussion
Investment
Startup funding Pre-seed to series A, B, C brief discussion
হোয়াইট লেবেল নাকি প্রাইভেট লেবেল ই কমার্স?
E-Commerce
হোয়াইট লেবেল নাকি প্রাইভেট লেবেল ই কমার্স?