যোগান বিধি বা (Law Of Supply) কী?

2279
article image

সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময়ে অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকলে দ্রব্যের দাম কমলে যোগান কমে এবং দাম বাড়লে যোগান বাড়ে। দাম এবং যোগানের এই সম্পর্ককেই যোগান বিধি বা Law of Supply বলে। দামের সঙ্গে যোগানের যে আপেক্ষিক বা ক্রিয়াগত সম্পর্ক বিদ্যমান তাকেই যোগান বিধি বলে।

Key Points

  • যোগান বিধি কার্যকর হবার জন্য অন্যান্য অবস্থা যেমন: কাঁচামালের দাম, কারিগরি খরচ, ট্যাক্স ইত্যাদি অপরিবর্তিত থাকতে হবে।
  • যোগান বিধির ক্ষেত্রে ভোক্তা বা ক্রেতা বিজ্ঞ এবং যুক্তিশীল হবে।
  • যোগান বিধি মূলত ব্যবসায়ীদের লাভবান করে থাকে।
  • যোগান বিধি কার্যকর থাকলে বাজারে প্রয়োজনীয় পণ্য বা দ্রব্যের সংকট দেখা যায় না
  • চাহিদার সাথে যোগান পরিবর্তনশীল। চাহিদা বাড়লে মূল্য বাড়ে আর মূল্য বৃদ্ধি পেলে যোগান বাড়ে, যোগান বিধি কার্যকর হয়।

যোগান বিধি বা (Law Of Supply)

আমরা জানি দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে যোগান বাড়ে, মূল্য আর যোগানের এই সম্পর্ককেই যোগান বিধি বলে। যোগান বিধি আসলে ব্যবসায়ী বান্ধব একটি অর্থনৈতিক পদ্ধতি। যেমন ধরুন বাজারে এখন ঠান্ডা পানীয় এর চাহিদা ব্যাপক, যার ফলে ক্রমান্বয়ে এর মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেহেতু মানুষের কাছে এই পণ্যটির চাহিদা অনেক এবং মূল্য বৃদ্ধির পরও সেলস কমছে না, তখনই উৎপাদনকারী কোম্পানি এবং ব্যবসায়ীরা এর যোগান বৃদ্ধি করে দেয়। কারণ মূল্য বৃদ্ধি পাবার কারণে যোগান বৃদ্ধি করলে তাদের লাভ পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি হবে। ১ লিটার কোমল পানীয় এর মূল্য যদি ৬০ টাকা হয় তাহলে উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীরা যদি ১০০০ একক বিক্রি করে, সকল অবস্থা অপরিবর্তিত থেকে সেই একই ১ লিটার কোমল পানীয়-এর মূল্য ৭০ টাকা হলে তারা ১৫০০ একক বিক্রি করবে। কারণ এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা অধিক আয় করতে পারবে।

যোগান বিধি অনুসারে যে পণ্যের চাহিদা কম সেই পণ্যের দাম কম এবং সেই পণ্যের যোগানও কম। কারণ কম চাহিদা সম্পন্ন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় না এবং লাভ বেশি করা যাবে না বলে সেসব পণ্যের যোগানও বাড়ানোর হয় না।

অধ্যাপক আলফ্রেড মার্শাল যোগান বিধির প্রবক্তা।

দাম ও যোগানের মধ্যে প্রত্যক্ষ বা সরাসরি বা ধনাত্মক সম্পর্ক বিদ্যমান।



যোগান বিধির মূল কথা হচ্ছে দাম বাড়লে যোগান বাড়বে এবং দাম কমলে যোগান কমবে। কিন্তু যোগান বিধির স্বতঃসিদ্ধ নিয়মটি সব ক্ষেত্রে কার্যকরী হয় না। অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলেও এমন কিছু দ্রব্য আছে যাদের ক্ষেত্রে দামের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটলেও যোগানের তেমন কোন হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না। আবার এমন দ্রব্যও আছে যাদের দাম বাড়লে যোগান কমে এবং দাম কমলে যোগান বাড়ে। নিম্নে এই ধরনের অবস্থা ও যোগান বিধির ব্যতিক্রম বা সীমাবদ্ধতাগুলো আলোচনা করা হলো:-

যোগান বিধির ব্যতিক্রম বা সীমাবদ্ধতা

১| অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য:-

সমাজে এমন কিছু দ্রব্য আছে যা জীবন ধারণের জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। যেমন: লবণ একটি অতি প্রয়োজনীয় জিনিস। লবণ একটি এমন প্রয়োজনীয় জিনিস যার দামের হ্রাস-বৃদ্ধির ঘটলেও চাহিদার খুব একটা পরিবর্তন হয় না। এ কারণে যোগানেরও খুব একটা পরিবর্তন ঘটে না, তাই এক্ষেত্রে যোগান বিধি হয় না।

২| প্রকৃতি প্রদত্ত জিনিস:-

সমাজে এমন কিছু জিনিস আছে যা পাবার জন্য মানুষকে খুব একটা পরিশ্রম করতে হয় না। যেমন: নদী ও সাগরের পানি, আলো, বাতাস, জ্যোৎস্না, চাঁদের আলো, সূর্য কিরণ ইত্যাদি প্রকৃতি প্রদত্ত জিনিসের যোগান যে কোন পরিস্থিতিতে মোটামুটি অপরিবর্তিত থাকে। তাই এগুলোর দাম বা চাহিদার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটলেও খুব একটা পরিবর্তন হয় না।

৩| সীমাবদ্ধ জিনিস:-

যেসব জিনিসের যোগান সীমিত, সেসব জিনিসের ক্ষেত্রে যোগান বিধি কার্যকর হবে না। যেমন: জমির দাম বাড়লেও এর যোগান বাড়বে না।

৪| উৎপাদন খরচ:-

বিভিন্ন কারণে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলে কারণে পণ্যের মূল্য পেলেও যোগান বিশেষ বাড়ে না। কারণ এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের মুনাফা কমে।

৫| প্রাকৃতিক অবস্থা:-

প্রাকৃতিক অবস্থা প্রতিকূল হলে উৎপাদন ব্যহত হয়, সে সময় মূল্য বৃদ্ধি পেলেও যোগান বৃদ্ধি করা সম্ভব হয় না, তাই অবস্থায় যোগান বিধি কার্যকর হয় না।

৬| উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা:-

যেসব দ্রব্য একবার উৎপাদিত হয়েছে কিন্তু নতুন করে এগুলোকে আর উৎপাদন করা যাবে না, সেই ক্ষেত্রে যোগান বিধি কার্যকর হয় না। যেমন: বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা, বিদ্রোহী কবি নজরুলের গান, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের ছবি, লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসা ছবি ইত্যাদির দাম ও চাহিদা যতই হ্রাস-বৃদ্ধি হোক না এদের যোগান সর্বদা অপরিবর্তিত থাকবে।

৭| শ্রমের বাজার:-

উৎপাদনের একটি অতি প্রয়োজনীয় উপাদান হচ্ছে শ্রম। শ্রমের ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায় শ্রমিকের মজুরি হ্রাসের ফলে শ্রমের যোগান বাড়ে এবং মজুরি বাড়লে যোগান কমে। শ্রমিকের মজুরি বাড়লে আয় প্রভাব (Income Effect) এবং পরিবর্তক প্রভাবের (Substitution Effect) ফলে শ্রমের যোগান কমে। শ্রমের মজুরি বৃদ্ধি পেলে শ্রমিকেরা অধিক উপার্জনের আশায় বেশি পরিশ্রম করতে আগ্রহী হয়। এ সময় শ্রমিকরা বিশ্রামের পরিমাণ কমিয়ে পরিশ্রম বেশি করবে। এটা পরিবর্তক প্রভাব। আবার মজুরি হ্রাস পেলে শ্রমিকরা অনেক সময় পরিশ্রম কমিয়ে বিশ্রাম বেশি করতে পারে। এটা পরিবর্তক প্রভাবের জন্য শ্রমের যোগান বাড়ে এবং আয় প্রভাবের জন্য যোগান কমে। তাছাড়া একজন শ্রমিকের বেতন যতই বৃদ্ধি করা হোক, একটি নির্দিষ্ট স্তরের পরে সে আর শ্রমের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারে না।

৮| অর্থনৈতিক দূরাবস্থা:-

অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলে উৎপাদকের নিকট অর্থের প্রয়োজন দেখা দেয়, সেই সময় দাম কম হলেও উৎপাদক যোগান বেশি দিতে পারে, ফলে এক্ষেত্রে যোগান বিধি কার্যকর হয় না।

৯| মৌসুমী দ্রব্যের ক্ষেত্রে:-

মৌসুমী দ্রব্যের ক্ষেত্রে অসময়ে দাম বেশি হলেও অধিক যোগানের সম্ভাবনা থাকে না। আবার ভরা মৌসুমে দাম কম হলেও যোগানের পরিমাণ কমে না।

১০| সংরক্ষণের সমস্যা:-

কোন দ্রব্য উৎপাদনের পর তা সংরক্ষণের সুব্যবস্থা না থাকলে উৎপাদনকারী বা চাষিরা এর মূল্য কমলেও তা বিক্রি করে দেয়। যেমন: ফসল উত্তোলনের সময় সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় জায়গা থাকে না বলে চাষিরা ফসলের দাম কমলেও যোগান বাড়িয়ে দেয়, আবার পচনশীল দ্রব্যের ক্ষেত্রে দাম কমলে দ্রব্য নষ্ট হবার ভয়ে যোগান বাড়িয়ে দেয়।

যোগান বিধি কাদের জন্য এবং কেন প্রয়োজন?

যোগান বিধির মাধ্যমে মূলত উৎপাদনকারী, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের লাভ হয়ে থাকে, তাই তাদের জন্যই যোগান বিধি প্রয়োজনীয়।

বেশি লাভের উদ্দেশ্য:-

আমরা জানি মূল্য বৃদ্ধি পেলে পণ্যের যোগান বাড়ে। আর যোগান বৃদ্ধি মানে ব্যবসায়ীদের বিক্রয় বৃদ্ধি, আর বিক্রি বৃদ্ধি পেলে ব্যবসায়ীদের লাভ বা প্রোফিট বাড়ে। তাই ব্যবসায়ীরা মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে যোগানের পরিমাণ বাড়াতে থাকে অতিরিক্ত লাভের জন্য।

সরবরাহ ও ব্যবসায়ীর সংখ্যা বৃদ্ধি:-

মূল্য বাড়লে যোগান বাড়ে আর যোগান বাড়লে লাভ বৃদ্ধি পায়। লাভ বৃদ্ধি পেলে নতুন নতুন সম্ভাব্য ব্যবসায়ী এবং সরবরাহকারীরা ব্যবসা করতে আগ্রহী হয়, যার ফলে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। যা দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক!

উপসংহার

যোগান বিধির মাধ্যমে আমরা জানলাম কখন এবং কেন যোগানের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। যোগান বিধি যেহেতু ব্যবসায়ীদের জন্য একটি লাভ বা আয় বৃদ্ধি করার উপায়, সেহেতু সাধারণ ভোক্তাদের পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সর্তক হওয়া জরুরি। এই বিষয়ে সচেতন হলে ভোক্তারা প্রয়োজন অনুযায় পণ্য পাবে, ব্যবসায়ীরাও লাভবান হবে এবং নতুন ব্যবসায়ীর আগমন ঘটবে।

  • https://www.investopedia.com/terms/l/lawofsupply.asp
  • https://en.wikipedia.org/wiki/Law_of_supply
Next to read
Business Models
অ্যাড অন মডেল (Add On Model)
অ্যাড অন মডেল (Add On Model)

অ্যাড অন মডেলে মূলত কোনো একটি পণ্য বা পরিসেবার জন্য বাজারে অন্য প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের তুলনায় কম মূল্য (কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিনামূল্য) নির্ধারণের মাধ্যমে গ্রাহক চাহিদা সৃষ্টি করা হয়। আর পণ্য বা সেবাটি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন গ্রাহক মনে ঐ নির্দিষ্ট পণ্য বা পরিষেবার বাইরেও ঐ পণ্য সংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত ফিচার কিংবা সেবার প্রতি প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়। এর ফলে গ্রাহক ঐ পণ্যটির বাইরেও অন্যান্য পরিষেবা গুলোও অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করে। এভাবে এই অ্যাড অন বিজনেস মডেল টি মূলত কাজ করে থাকে।

কাস্টমার ডাটা মনেটাইজেশন মডেল (Customer Data Monetization Model)
Business Models
কাস্টমার ডাটা মনেটাইজেশন মডেল (Customer Data Monetization Model)
ডিজিটাল মার্কেটিং কি এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ? ডিজিটাল মার্কেটিং এর ক্ষেত্রসমূহ
Marketing
ডিজিটাল মার্কেটিং কি এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ? ডিজিটাল মার্কেটিং এর ক্ষেত্রসমূহ
লোগোর উদাহরন (Example of Logos)
Logo
লোগোর উদাহরন (Example of Logos)
CSR বা Corporate Social Responsibility কী?
Business
CSR বা Corporate Social Responsibility কী?
ব্যষ্টিক অর্থনীতি বা Micro Economics কী?
Economics
ব্যষ্টিক অর্থনীতি বা Micro Economics কী?
এঞ্জেল বিনিয়োগ কি? এবং কিভাবে কাজ করে (What is angel investing & how does it work?)
Investment
এঞ্জেল বিনিয়োগ কি? এবং কিভাবে কাজ করে (What is angel investing & how does it work?)
PESTLE বিশ্লেষণ
Analysis
PESTLE বিশ্লেষণ
মার্কেটিং এ ৫ সি (5 C's Of Marketing)
Marketing
মার্কেটিং এ ৫ সি (5 C's Of Marketing)
ডিমার্কেটিং (DeMarketing)
Marketing
ডিমার্কেটিং (DeMarketing)