ভোক্তা মূল্য সূচক Consumer Price Index (CPI)

2384
article image

ভোক্তা মূল্য সূচক (CPI) হল একটি অর্থনৈতিক সূচক যা সময়ের সাথে সাথে সাধারণ ভোক্তাদের দ্বারা ক্রয়কৃত পণ্য ও সেবার গড় মূল্য পরিবর্তনকে পরিমাপ করে। এটি মূলত মুদ্রাস্ফীতি পরিমাপ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

Key Points

  • সিপিআইকে একটি সূচক বলা যেতে পারে যার দ্বারা সরকার সাধারণ স্তরের মুদ্রাস্ফীতি হিসাব করে থাকে।
  • সিপিআই মূলত একটি পরিসংখ্যানগত অনুমান।
  • সিপিআই স্বতন্ত্র অর্থনীতির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধ্রুবক।
  • প্রতিনিয়ত পণ্য এবং সেবার বাজার মূল্যের যে পরিবর্তনকে সাধিত হয়, সিপিআই তা হিসেব করে থাকে।
  • বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকরা সিপিআই নির্ণয়ের যে উপায় অবলম্বন করেন, তা পরিপূর্ণ ভাবে সঠিক নয়।

ভোক্তা মূল্য সূচক বা Consumer Price Index

মুদ্রাস্ফীতি মূল্যায়নের অনেকগুলো পদ্ধতির মধ্যে সবচেয়ে ব্যবহৃত এবং কার্যকর পদ্ধতি হলো সিপিআই। এই পদ্ধতিতে সাধারণত জনগণের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এবং নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাস্কেট (চাল, ডাল, কাচা-তরকারি ইত্যাদি) এর গত বছরের মূল্যের সাথে বর্তমান বছরের মূল্যের পার্থক্য বের করা হয়।

উদাহরণের মাধ্যমে সিপিআই মূল্যায়নের পদ্ধতি

ধরুন আপনি ২০২১ সালে ৭৫০ টাকা দিয়ে ৫ কেজি চাল, ২ কেজি ডাল এবং ১ লিটার তেল কিনেছিলেন। কিন্তু সেই একই পরিমাণ চাল, ডাল এবং তেল কিনতে আপনাকে ২০২২ সালে খরচ করতে হয়েছে ৯০০ টাকা। এই যে একবছরে ব্যবধানে আপনার বাস্কেটের বা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য ১৫০ টাকা বেড়ে গেল। এই পার্থক্যটিই সিপিআই নির্দেশ করে এবং এটিই মুদ্রাস্ফীতি নির্ণয়ের অন্যতম বহুল ব্যবহৃত একটি নিয়ম।

ভোক্তা মূল্য সূচক বা সিপিআই খুবই গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রার অবস্থা বা মূল্য বোঝার জন্য। যদি ভোক্তা মূল্য সূচক বৃদ্ধি পায় তবে এর অর্থ দাঁড়ায় যে জাতীয় মুদ্রা এর ক্রয় ক্ষমতা হারাচ্ছে। আর যদি ভোক্তা মূল্য সূচক হ্রাস পায় তবে এর অর্থ দাঁড়ায় যে জাতীয় মুদ্রা এর ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আরও বলতে হয় যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে ভোক্তা মূল্য সূচক এর তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে, বিশেষ করে সুদের হার নির্ধারণে।

একটি দেশের মুদ্রাস্ফীতি পরিমাণ করার ক্ষেত্রে ভোক্তা কতটুকু ভোগ করেছেন এবং ভোগের বিনিময়ে কোন কোন দ্রব্যে কতটুকু ব্যয় করেছিলেন সেই হিসেব করেই সাধারণত সিপিআই নির্ণয় করা হয়ে থাকে।

কিভাবে CPI গণনা করা হয়?

  • পণ্য ও সেবার বাস্কেট: প্রথমে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি "পণ্য ও সেবার বাস্কেট" তৈরি করা হয়। এই বাস্কেটে সাধারণ ভোক্তারা যেসব পণ্য ও সেবা ক্রয় করে, সেগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে।
  • মূল্য নির্ধারণ: পরবর্তী সময়ে, বাস্কেটের পণ্য ও সেবার মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
  • সূচক গণনা: একটি নির্দিষ্ট সময়কে ভিত্তি হিসেবে ধরে, বর্তমান সময়ের পণ্য ও সেবার মূল্যের গড় পরিবর্তনকে একটি সূচকের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।

সিপিআই নির্ণয়ের পদ্ধতি



ভোগ্য পণ্যের নামভিত্তি বছরের দাম (Qo)ভিত্তি বছরের পরিমাণ (Po)ব্যয় (PoQo)চলতি বছরের দাম (Pn)ব্যয় (PnQo)
চাল৩৫৩০১০৫০৩৮১৩৩০
গম১০২৮২৮০৩২৩২০
চিনি৩৫১৭৫৪৩২১৫
বিবিধ১২২০২৪০২৪২৮৮
মোট

=১৭৪৫
=২১৫৩



সিপিআই নির্ণয়ের সূত্র:

CPI= ( ΣPnQo ÷ ΣPoQo ) × ১০০

= ( ২১৫০ ÷ ১৭৪৫ ) × ১০০

=১২৩.৩৮ - ১০০

= ২৩.৩৮%।





এখানে,

Pn= চলতি বছরের দাম।

Qo= চলতি বছরের পণ্যের পরিমাণ।

Po= ভিত্তি বছরের দাম।

Qo= ভিত্তি বছরের পণ্যের পরিমাণ।

বাংলাদেশের সিপিআই নির্ণয়ের ত্রুটি সমূহ

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দেশের মূল্যস্ফীতির হার গণনা করে থাকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জাতীয় পর্যায়ে এবং গ্রাম ও শহরাঞ্চলের জন্য ভোক্তা মূল্য সূচক (কনজ্যুমার প্রাইস ইনডেক্স বা সিপিআই) হিসাব করে। এই সূচকগুলো ব্যবহার করে শহর, গ্রাম ও জাতীয় পর্যায়ে মূল্যস্ফীতির হার গণনা করা হয়। শহর ও গ্রামের পরিবারগুলোর গড় আয়ের ওপর ভিত্তি ‌করে এই ভোক্তা মূল্য সূচক তৈরি করা হয়।

এই পরিবারগুলোর অর্থ ব্যয়ের ধরন বা ভোগের ধরন নিরূপণ করা হয় ২০০৫-০৬ সালের আয় ও ব্যয় জরিপের ভিত্তিতে। এ ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের জন্য দুটি আলাদা ভোগ্যপণ্যের তালিকা বা কনজ্যুমার বাস্কেট নির্ধারণ করা হয়। শহরের ভোক্তাদের এই তালিকায় আছে খাদ্য, অন্যান্য নানা ব্যবহার্য জিনিসসহ ৪২২টি পণ্য এবং একইভাবে গ্রামের ভোক্তাদের তালিকায় আছে ৩১৮টি পণ্য। ভোক্তা মূল্য সূচক তৈরি করতে কোন পণ্যের গড় মান (পরিসংখ্যানের ভাষায় যাকে বলা হয় ওয়েইট) কত হবে, সেটি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো নির্ধারণ করে একটি পরিবারের মোট খরচের কত অংশ কোন পণ্যের পেছনে যায়, তার ভিত্তিতে। আর এই উপাত্তের উৎস ২০০৫-০৬ সালের আয়-ব্যয় জরিপ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সিপিআই ও মূল্যস্ফীতি হিসাবের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রধানত দুটি সমালোচনার জায়গা আছে। প্রথমত, ২০১৬ সালে আয়-ব্যয়ের একটি জরিপ আছে এবং যার তথ্য-উপাত্ত ২০১৭ সাল থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরো এখনো কেন ২০০৫-০৬ সালের গৃহস্থালি আয় ও ব্যয় সমীক্ষার উপাত্ত ব্যবহার করছে, তা স্পষ্ট নয়। তাছাড়া যেখানে প্রতিনিয়ত তথ্য পরিবর্তন হচ্ছে, সেখানে পুরাতন তথ্য ব্যবহার করে সঠিক সিপিআই এবং মুদ্রাস্ফীতি পাওয়া সম্ভব নয়।

অন্যদিকে ২০০৫-০৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশের দরিদ্র ও সচ্ছল উভয় শ্রেণির মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো যখন সিপিআই হিসাব করে, তখন এই খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন বিবেচনায় নেয় না। দ্বিতীয়ত, শহর ও গ্রামাঞ্চলের নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চিত্র সিপিআইয়ের সরকারি হিসাবে প্রতিফলিত হয় না। সিপিআই গণনা করার জন্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো যে ভোগ্যপণ্যের তালিকা ব্যবহার করে, তাতে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর ভোগ বা ব্যয়ের প্রকৃত চিত্র আড়ালে থেকে যায়। অতএব মূল্যস্ফীতির ফলে প্রান্তিক দরিদ্র পরিবারগুলো যে চাপের মুখে পড়ে, তা সরকারি পরিসংখ্যানে প্রতিফলিত হয় না।

উপসংহার

সিপিআই মুদ্রাস্ফীতি মূল্যায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এটি দেশের পণ্য ও পরিষেবার দামের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে থাকে। দেশের সরকারের জন্য সিপিআই যেমন একটি প্রয়োজনীয় বিষয়, সেরকম ভাবে সাধারণ মানুষ হিসেবেও এই বিষয়ে জানা এবং জ্ঞান অর্জন করা আমাদের জন্য প্রয়োজনীয়। সিপিআই এবং পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতি সম্পর্কে ধারণা থাকলে আমরা অর্থ‌নৈতিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সঠিক ভাবে নিতে পারব। তাছাড়া অর্থনৈতিক ঝুকি থেকে রক্ষা পাব এবং ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত থাকব।

  • বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, দৈনিক প্রথম আলো এবং অর্থনীতি বই
Next to read
Canvas & Methods
বিজনেস মডেল ক্যানভাস ( Business Model Canvas)
বিজনেস মডেল ক্যানভাস ( Business Model Canvas)

মূলত ব্যবসা শুরু করার আগে যেকোনো উদ্যোক্তাকে একটা স্ট্র‍্যাটেজিক প্ল্যান নিয়ে আগাতে হয়, তার ব্যবসার সকল কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে কিভাবে পরিচালনা করবেন! সনাতনী পদ্ধতি অনুসরণ করে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখার চেয়ে বিজনেস মডেল ক্যানভাস অনুসরণ করা অধিকতর সহজ এবং কার্যকর। কারণ এই মডেল ব্যবহার করে আপনি নয়টি ব্লক তৈরি করে একটা পৃষ্ঠায় সবকিছু আলোকপাত করতে পারবেন যা আপনার নিজের এবং ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যাক্তির বুঝতে অনেকটা সহজ হবে।

বি-টু-বি, বি-টু-সি এবং বি-টু-জি কি? (B-to-B, B-to-C, B-to-G)
Business
বি-টু-বি, বি-টু-সি এবং বি-টু-জি কি? (B-to-B, B-to-C, B-to-G)
লোগোর প্রকারভেদ (Types of Logos)
Logo
লোগোর প্রকারভেদ (Types of Logos)
ব্রান্ডিং (Branding)
Branding
ব্রান্ডিং (Branding)
রিব্র্যান্ডিং (Rebranding)
Branding
রিব্র্যান্ডিং (Rebranding)
ব্যবসায়কি আইন কি? উদাহরণ সহ বিভিন্ন প্রকার ব্যবসায়কি আইন
Business Law
ব্যবসায়কি আইন কি? উদাহরণ সহ বিভিন্ন প্রকার ব্যবসায়কি আইন
অ্যাম্বুশ মার্কেটিং (Ambush Marketing)
Marketing
অ্যাম্বুশ মার্কেটিং (Ambush Marketing)
সেলস টার্গেট অর্জনের জন্য ১০টি বডি ল্যাঙ্গুয়েজ টিপস
Sales
সেলস টার্গেট অর্জনের জন্য ১০টি বডি ল্যাঙ্গুয়েজ টিপস
World Trade Organization (WTO) Agreements
Agreement
World Trade Organization (WTO) Agreements
অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং (Affiliate Marketing)
E-Commerce
অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং (Affiliate Marketing)